আরশি (নির্বাচিত গল্প)


লেখক- সাখাওয়াত



"১৩ই নভেম্বর!
হৃদির কাল জন্মদিন।
জন্মদিনে সে আসমানী রঙের শাড়ি পরবে, সেজেগুজে আমায় চতুর্থবারের মতোন প্রপোজ করবে। এমনিই কথা।
হৃদি যে সাজুগুজু করবে- পুরো সময়টায় একটিবারের জন্যও আয়না দেখবেনা। আপনার বিশ্বাস হয়? হা হা। কোনো বিদ্বান ব্যক্তি বলেছিলেন, মেয়েদের জন্য দারুণ শাস্তি হলো প্রচুর জামা কাপড় আর সাজুগুজু করার জিনিসপত্র দিয়ে ভর্তি একটা রুমে দরজা বন্ধ করে আটকে রাখা। হ্যাঁ, রুমে আয়না থাকবেনা একটাও।
হৃদি অদ্ভুত একটা মেয়ে। আয়না ভয় পায়।
'হৃদমাঝার' নামের একটা তের তলা বিল্ডিং এর ষষ্ঠ তলায় একা থাকি আমরা। ষষ্ঠ তলায় আমাদের পাশেই থাকেন এক নিঃসন্তান ভদ্রলোক, স্ত্রীকে নিয়ে। হৃদিকে খুব স্নেহ করেন দুইজন। আমাদের দিকে তাকিয়ে লুকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন। নিজেদের সন্তান থাকলে- এরকম ই বড় হতো। এটা আমার ধারণা। হৃদি এদের পছন্দ করেনা।
হৃদির ভয়জনিত কারণে বাসায় একটা আয়নাও নেই।
আমি নিজেই মোবাইলের ক্যামেরা অন করে আয়না দেখার কাজ সারি। হৃদির চোখে মুখে ভয় এসে লেপ্টে থাকে তখন, আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
হৃদির ভয়টা ভাবিক ধরে নিয়েছিলাম। মেয়েরা তেলাপোকার মতোন নিরীহ প্রাণীকেও ভয় পায়...। কারণ ছাড়া। আয়নার ব্যাপারটাও তেমন ভেবেছি। প্রথম ভুল ভাঙলো কিছুদিন পর।
বাইরে ঘুরতে যাব।
হৃদি শাড়ি পরবে। দেয়ালের দিকে মুখ করে টেনে পরনের জামা কাঁধ পর্যন্ত খুলেই পেছন ফিরলো; আমি আড়চোখে তাকিয়ে আছি। চোখ পড়তেই হেসে ফেললাম। হৃদি চোখ পাকিয়ে কলার চেপে ধরে টানতে টানতে রুমের বাইরে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। কি মুশকিল। আমারই তো বৌ! জামা চেঞ্জ করার সময় আমারও তাকানো বারণ?
হৃদি ভেতর থেকে কপট রাগ করে ধমক দেয়,
-- লুচুমি করবানা বেয়াদব, কি খবিশ দৃষ্টি তোমার, ছিঃ
হৃদি পনের মিনিটের মধ্যে সেজেগুজে রেডি। দরজা খুলতেই আমি হা করে তাকিয়ে থাকি। আয়না ছাড়াই একটা মেয়ে এত সুন্দর সাজতে পারে কিভাবে! হৃদির চোখে কাজল, কপালের ঠিক মাঝখানে কালো টিপ, কিছু চুল বাঁ কাঁধ বেয়ে নেমে বুকের একপাশ নদী করে রেখেছে... আমার চোখে ওটা টলটল করে। হৃদি চোখ পাকায়,
আবার? আল্লাহ কি পাপ করছিলাম, এরকম খবিশ জামাই-ই ক্যান কপালে জুটলো!’
হৃদির কথা শেষ হতে না হতেই দরজায় নক করলো কেউ, দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে পাশের বাসার ভদ্রমহিলা ঢুকে পড়লেন। হাতে একটা বর্গাকৃতির ছোট্ট আয়না। ঝকমকে রঙচঙা অনেকগুলো পাথর সোনালী রঙা ফ্রেমের চারোপাশে সুন্দর করে বসানো। ঝলমল করছে। রুমে ঢুকেই হড়বড় করে বললেন,
হৃদি দেখো দেখো, তোমায় ওইদিন বললাম না, শশুর আব্বা কত্ত কি দিয়েছেন বিয়েতে.. সব তো দেখালাম, এটা ওইদিন খুঁজে পাইনি। দেখো, এটা সবচে মূল্যবান। আমাদের ওদিক কার জমিদার বাড়ির সেঝ রাণীমার আয়না এটা। আব্বা তখন কার সময়ে তেরোশ টাকা দিয়ে কিনেছিলেন, এক চোরের কাছ থেকে।
আমি কিছু একটা বলতে যাবো, হুট করে ভদ্রমহিলার খেয়াল হলো আমরা কোথাও যাচ্ছি। বেশ লজ্জা পেলেন। বললেন,
কোথাও যাচ্ছো বুঝি ইশশ.. অসময়ে চলে এলাম।
আমি হৃদির দিকে তাকাই। একদৃষ্টিতে আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে সে। অল্প কিছুক্ষণ তারপর একছুটে আমার পেছনে এসে লুকোয়। দুহাতে খামচি দিয়ে ধরে পেছন থেকে আমায়, শক্ত করে ধরে রেখে কাঁপতে থাকে। খসখসে স্বরে বলে,
ইনাকে জলদি বের হতে বলো
ভদ্রমহিলা হৃদির অদ্ভুত আচরণে ভ্যাঁবাচেঁকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার দুইহাতের বাহুতে হৃদির লম্বা নখ চেপে বসে চামড়া ভেদ করেছে ততক্ষণে... হৃদি পেছন থেকে উঁকি দিয়ে ভদ্রমহিলার হতবিহ্বল চোখে চোখ রেখে চিৎকার করে,
বের হ বদমাইশ, গলা টিপে মেরে ফেলবো তোকে...
ভদ্রমহিলা একমুহূর্ত দেরি না করে দৌঁড়ে বের হয়ে যান। আমি চোখ বুজে হাতের মাংসে নখ বসে যাওয়ার তীব্র যন্ত্রনা সহ্য করার চেষ্টা করি। হৃদি স্ববাভিক হয়ে আসে। আমায় ছেড়ে টলতে টলতে সামনে পা বাড়ায়, দুহাতের নখ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত ঝরছে। সে এক বিভিৎস দৃশ্য। দুপা সামনে বাড়িয়ে হৃদি লুটিয়ে পড়ে মেঝেতে... জ্ঞান হারায়।


2
রাতে হৃদির জ্বর বাড়ে।
প্রলাপ বকে। ডাক্তার দেখানো হয়েছে। জলপট্টি দিই পাশে বসে আমি। হৃদি কাতর স্বরে ডাকে আমায়,
অনি..অনি
আমি কপালে হাত বুলোই, হৃদি চোখ পিটপিট করে তাকায়। খসখসে স্বরে বলে,
তোমায় একটা কিছু বলা হয়নি গো...
আমি ঠোঁটে আঙুল রেখে চুপ করতে বলি। হৃদি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলে,
আমার সাথে কেউ একজন থাকে গো...
রাত্রি সাড়ে দশটা বাজে। বন্ধ জানালার ওপাশে ঘন কালচে অন্ধকার, এপাশে বৈদ্যুতিক বাল্ব। ঝলমলে আলোয় বিছানায় শুয়ে থাকা একটা অসুখী দেহ!
আমি ভীতু মানুষ না, তবুও হৃদির কান্না এবং খসখসে স্বরে আমার শরীরে হিমশীতল একটা শিহরণ বইয়ে দেয়। আমি চুপ করাই হৃদিকে,
আর কথা বোলোনা। তোমার অসুখ করেছে।
আমি জীবনে ভুলবোনা, এই গলার স্বর। সমস্ত শরীরের পশম দাঁড়িয়ে গেলো। ভয়ংকর একটা চিৎকার গলার মাঝখান বরাবর এসে আটকে রইলো। হৃদি উঠে বসেছে বিছানায়। আমার দিকে ঘোলা চোখে তাকিয়ে স্পষ্ট পুরুষকন্ঠে বললো,
ভাত খাব। পাখি ধরে আন দেথি ক’টা। জবাই করবি আল্লাহর নাম নিয়ে। রক্ত এক প্লেটে রাখবি, মাংস ফেলে দিবি- হাড্ডিগুলো ভাতের পাতে সাজাবি। বুঝেছিস
আমার সারা গায়ে ঘাম দেয়, প্রচণ্ড চেষ্টা করি স্ববাভিক থাকতে। এটা হৃদি। আমার স্ত্রী। ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। জ্বরের ঘোরে ভুলভাল বকছে। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে চোখ বুজি আমি। হৃদি বিছানা ছেড়ে উঠে বারান্দায় যায়, শাড়ি খুলে পড়ে থাকে বিছানা থেকে বারান্দা অবধি... আমি শক্ত কাঠ হয়ে বসে থাকি।
পাশের বাসায় ছুটে যেতে ইচ্ছে করে, পা নাড়ানোর ক্ষমতা নেই। আমি দরদর করে ঘামছি। বারান্দা থেকে পুরুষকন্ঠের আওয়াজ আসছে,
আমায় দ্যাখ একটু, পছন্দ হবে তোর.. হবেই। শিং আছে দ্যাখ.. হাত দে.. রক্ত খেতে দিবি আমায়? একটু চুষে নেব, আরাম পাবি... আচ্ছা, ঘুমা...’
হৃদি হি হি করে হেসে উঠে।


3
সকাল সকাল ঘুম ভাঙে আমার, হৃদি মেঝেতে কাত হয়ে শুয়ে, শাড়ি আধেক খুলে পড়ে আছে। সমস্ত শরীরে আঁচড়। কাঁধে, গলায়, মুখে, হাতে.. চিকন চিকন নখের আঁচড়!
হাত বাড়িয়ে কপাল ছুঁতেই ঝট করে হাত সরিয়ে দেয় হৃদি, জেগে উঠে। চমকে যায়। আমার লালচে চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,কি হয়েছে?
হৃদির কিছুই মনে নেই। আমি ঢোক গিলি। হৃদি ইতস্তত করে হাত বাড়ায় আবার, আমার হাতে ব্যান্ডেজ... নার্ভাস স্বরে জিজ্ঞেস করে,
তোমার হাতে ব্যান্ডেজ কেন?
পরম মমতাময়ী মেয়েটার হাতের স্পর্শ আমার বুকে গিয়ে বিঁধে। হৃদি নিজের গায়ে হাত বুলায়, আঁচড়ের দাগ।
ভয়ে মুখ পানসে হয়ে আসে।
ভীত ¯^রে বলে,
আমায় খেয়ে নেবে ও... আমি জানি’
'ও' টা কে? আমি জানিনা। হৃদি শুধু ভয় পায়।
হৃদির শরীর ভেঙে আসে ক'দিনের ভেতর। ডাক্তার দেখাই। শরীরে নতুন রক্ত তৈরী হচ্ছেনা সঠিক মাত্রায়। প্রচণ্ড দুর্বল। প্রতিরাতে নতুন করে আঁচড়ের দাগ বসে... আমি ডাক্তারের আশা ছেড়ে দিই। প্রানপনে সুস্থতা চাই ঈশ্বরের কাছে, এইটুকুন ইচ্ছে!
আমরা ঈশ্বরের কাছে দশটা ইচ্ছে ফেলে ওই একটাই ইচ্ছে চাই- যেটা উনি দেয়ার ইচ্ছে রাখেন না।
হৃদি সুস্থ হয়না, ওর অসুখ বাড়ে। শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসে শরীর।
আমি প্রতিটা মুহূর্তে টের পাই, একটা কালো ছায়ার মতোন কিছু একটা নিয়ে ঘুরছে সে পুরো বাড়ি। খাচ্ছে, ঘুমোচ্ছে। ভুত বিশ্বাস করিনা আমি; জ্বিন করি।
প্রতিটা মানুষের সাথে একটা করে জ্বিন থাকে, ক্বারিন জ্বিন বলে ওটাকে। বই পড়তে শুরু করি আমি- জ্বিন সম্পর্কিত যা কিছু পাই, পড়ে ফেলি। দ্রুত জানতে পারলাম, জ্বিন আর মনুষ্যের সঙ্গমে যে সন্তান জন্ম নেয়, তার নাম খুন্নাস। বাংলায়, হিজড়া। ইতিমধ্যে পড়ছি, জ্বিন জাতির বিষ্ময়কর ইতিহাস। লেখক, আল্লামা জালালউদ্দীন সুয়ূতি (রহঃ)। জ্বিনদের মধ্যে ভাগ আছে। ঘুল, সিলা, ভেতালা, হিন, নাসনাস, পালিশ, খান্নাস, যাথুম... বিশেষ প্রজাতির জ্বিন এরা। ঘুল কবরস্থানে থাকে, খান্নাস থাকে বাথরুমে। এজন্য বাথরুমে গভীর রাতে আয়না দেখতে হয়না।
আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবির পেছনে ভয়ংকর কোন চেহারার কাউকে দেখে ফেলা অসম্ভব কিছু না।
আয়নার বিষয়টাই হৃদির ব্যাপারে আমায় পুরোপুরি সন্দেহমুক্ত করে।
হৃদি একা নয়। কিছু একটা আছে ওর সাথে।
হৃদিও আয়না দেখতে ভয় পায়।


4
হৃদির সঙ্গে থাকা ভয়ংকর রক্তচোষা জ্বিনটার সাথে আমার প্রথমবার ¯^চ¶ে দেখা ও কথা হয় এক স্মরণীয় রাতে। রাতটা স্মরণীয় কেন, পরে বলছি...
রাত দুটোয় আমার ঘুম ভাঙ্গে।
পাশে হাত বাড়িয়ে হৃদি আছে কিনা দেখি, ইদানিং প্রায় রাত সে বারান্দায় কাটায়। কেউ একজন তাকে পছন্দ করে, ছুঁতে চায়। হৃদি হি হি করে হাসে। চুমু খায় ওকে। চুমুর শব্দ বারান্দার শক্ত দরজা ভেদ করে রুমে আসে। ভয়ংকর অস্থির হয়ে উঠি।
সকালে উঠে হৃদি সব ভুলে যায়। গায়ে একগাদা আঁচড় নিয়ে। ¶ত শুকোয়, নতুন করে আবার গজায়। পঁচন ধরে চামড়ায়।
আমি হাত বাড়িয়ে বিছানায় শুয়ে থাকা হৃদির শরীরের গন্ধ পাই।
হৃদি শুয়ে আছে, এদিক মুখ করে। মায়াবী একটা মুখ। টলটল করছে আদুরে আভা। চোখের নিচে, নাকের পাশে একটা করে আঁচড়। চিকন নখ দিয়ে খাবলা দেয়া হয়েছে যেন। আলতো করে ওখানটায় ছুঁয়ে দিই আমি। ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য উঠি।
ওয়াশরুমের দরজা খুলেই বুক কেঁপে উঠে। একটা ঠাণ্ডা কালো ছায়া যেন হুট করে দরজায় আমার পাশ কেটে চলে যায়। হৃদি। ওয়াশরুমের ভেতরে এক কোণায় গুটিশুটি মেরে বসে কাঁপছে। পুরো নগ্ন, ফর্সা শরীর বেলি ফুলের মতোন ফুটে আছে এক কোণে। পুরো শরীরে একটা আঁচড়ের দাগ ও নেই। এ যেন, সেই প্রথমবার দেখা হৃদি.. আমার কলিজা। টেনে তুলতে যাই ও কে আমি... পর¶ণেই মনে পড়ে বিছানায় আমার পাশেই শুয়ে আছে আরেকজন, সে ও হৃদি। তার মুখে আঁচড়ের দাগ!
মাথায় ভোঁ ভোঁ শব্দ হয়, হৃদি আরো গুটিশুটি মেরে বসে থাকে। ফ্যাসফ্যাসে ¯^রে বলে,
ছুঁয়োনা আমায়, দুরে.. দুরে থাক.. সব রক্ত চুষে নেবে ও... সব..
আমি পা টিপে টিপে বিছানায় আসি। এই তো হৃদি শুয়ে আছে বিছানায়। টলতে টলতে এক পা পেছনে যাই। ঠিক তখুনিই প্রথমবারের মতোন 'মারকাওয়া'কে দেখতে পাই!
মারকাওয়া ওই জ্বিনটার নাম।
আপনি একটু হাত বাড়িয়ে আমায় ধরুন, দেখুন কাঁপছি এখনো আমি। আমার স্পষ্ট মনে আছে ওই বিভৎস চেহারা।
লম্বা জট পাকানো চুল, ধারালো শিং এর মতোন কিছু একটা কপাল ফুঁড়ে বের হয়ে আছে। পুরো মুখে কাটাকুটি দাগ, ব্লেড দিয়ে আঁচড় কাটার মতোন। উঁচু নাক, চোখের জায়গায় কালো গর্ত.. গর্তের মাঝখানে আগুনের টুকরো জ্বলছে স্রেফ! পুরো নগ্ন একটা দেহ। হাওয়ায় ভাসা ভাসা। আমি এক দু'পা করে পেছনে যাই। মারকাওয়া এক পা দু'পা করে এগোতে এগোতে বলে,
তুই কাপড় খুলিস না কখনো। আয়না দেখবি না। ভয় পাবি। বুঝেছিস?
বারান্দায় পিঠ রেখে দাঁড়াই আমি। মারকাওয়া সামনে এসে দাঁড়ায়। পান্তা ভাত হাঁড়িতে কয়েকসপ্তাহ ফেলে রাখলে যে উৎকট গন্ধ বের হয়, মারকাওয়ার শরীরে ওরকম গন্ধ। আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। মারকাওয়া জানায়, আজ রাতেই হৃদি মারা যাবে। সমস্ত রক্ত চোষা শেষ।
এরপর মারকাওয়া সঙ্গি হবে আমার। হৃদির অসুখ আমায় এসে জেঁকে ধরবে। মারকাওয়া হি হি করে হাসতে হাসতে নাভির নিচ বরাবর হাত দেয় আমার, জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,
ভয় পাস নে, এখন ¶িধে নেই।
নাভির নিচে শক্ত লোহার মতোন কিছু একটার স্পর্শ পেতেই আমি জ্ঞান হারাই।
হৃদি মারা গেল ওই রাতে।
বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে। আর তারপর থেকেই মারকাওয়া আমার সাথে আছে। আপনি জানতে চাইছিলেন, আমার হাতে পায়ে শরীরে চিকন চিকন নখের আঁচড় কোথা থেকে হলো!
এটাই গল্প!
বিশ্বাস হয়েছে আপনার?
আপনার কাছে আসার কোন ইচ্ছে আমার ছিলোনা। ডাক্তার আমার কিছুই করতে পারবেনা আমি জানি। মারকাওয়া আমায়ও চুষে খাবে। আয়না দেখিনা আমি এখন ভয়ে, প্রতি রাতে ঘুম ভেঙে উঠে দেখি হাতে পায়ে পুরো শরীরে আঁচড়।
শরীর শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে।
মারকাওয়া হাসছে এখন, আমার পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে।
আপনার যন্ত্রপাতির উপর থুতু ছিটাচ্ছে।
হৃদির লেখা লম্বা সুইসাইড নোটে আপনার ঠিকানা নাম্বার ছিলো। হৃদির শেষ ইচ্ছে ছিলো.. আপনার সাথে দেখা করার, গল্পটা খুলে বলার।
জীবিত থাকতে পারেনি। আমি আমার মৃত স্ত্রীর হয়ে এসেছি, শেষ ইচ্ছে পুরণ করতে। মারকাওয়া কখন থেকে আছে হৃদির সাথে আমি জানিনা, আমার পর কাকে ধরবে সেটাও জানিনা। শুধু জানি, আমি তাড়াতাড়ি মারা যাচ্ছি,
এইটুকুই।"


5
ডাক্তার পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন আমার দিকে।
এত লম্বা সময় ধরে গল্প বলার মাঝখানে টু শব্দটিও করেন নি। এমন দারুণ শ্রোতা অনেকদিন পাইনি।
কিছু¶ণ তাকিয়ে থেকে কপাল চুলকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন শুধু,
আসার সময় বাসে করে এসেছেন?
আমি অবাক হই, এটা কি অসুখ সম্পর্কিত প্রশ্ন। এই প্রশ্ন দিয়ে মারকাওয়াকে তাড়ানো যাবে?
হুম, বাসে করেই আসছি। কেন?’
খুলে বলুন, কোন কিছু অ¯^াভাবিক লেগেছে?
আমি চোখ বুজলাম।
ডাক্তার সাহেব প্রচুর বুদ্ধিমান। হৃদির মৃত্যুর পর, মারকাওয়া যখন থেকে সাথে থাকছে... অ¯^াভাবিক অনেক কিছুই ঘটছে।
পাশের বাসার ভদ্রমহিলাটি গায়ে পড়ে এসে গল্প করেন। এতটুকু শান্তনা দেন না। হৃদির মৃত্যু যেন কিছুই নাহ। আমার অ¯^স্তি লাগে, ভদ্রলোকের সাথে কথা বলার সময় ভদ্রলোক অ¯^স্তি বোধ করেন। আমার দিকে তাকাতেই চান না। মারকাওয়া তাকে ভয় দেখায়।
রাস্তায় সবচে বেশি উদ্ভট ঘটনা ঘটছে। পাশে মারকাওয়া থাকে, অদ্ভুত সব আওয়াজ করে, হাত তালি দেয়। পথচারী, টং দোকানের আজেবাজে লোকজন, ছেলে পেলে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। লজ্জা পাই।
বাসে করে আসার সময়, পুরো বাস ভর্তি। মহিলা সিট একটা ফাঁকা, আমি দাঁড়িয়ে থাকি ঝুলে। মহিলাটি ডাক দেয়, পাশে বসতে। আমি বসিনা৷ পুরো বাসের লোকজন কেমন করে যেন তাকায়। মারকাওয়া গিয়ে মহিলাটির কোলে বসে থাকে। হেল্পার এসে বলে, দাঁড়িয়ে না থাকতে। খারাপ দেখায়। সিটে বসতে। আমি না করি। একজন ভদ্রলোক সামনের স্টপেজে নামতেই, আমি তার সিটে বসি। পাশের ভদ্রলোক দু'জনের মাঝখানে যথেষ্ট ফাঁক রেখে নড়েচড়ে বসে। বাসের লোকজন আবার আমার দিকে তাকায়। মারকাওয়া খিক খিক করে হাসে।
ডাক্তারকে বলি এসব।
ডাক্তার একটা আয়না বের করে টেবিলে রাখে। আমার পুরো শরীর থরথর করে কাঁপে। ডাক্তার শান্ত ¯^রে বলে,
ভয় পাবেন না। আয়নায় তাকান...
মারকাওয়া প্রচণ্ড রেগে গিয়েছে। ঘাড়ের কাছটা, ওর গরম নিঃশ্বাসে পুড়ে যাচ্ছে যেন। ঘাড় ঘুরিয়ে রেখেছে আমার। ভয় দেখাচ্ছে। আয়না দেখলেই সব শেষ। আমি চিৎকার দিই, আমি পারছিনা। হাতের মুঠো খুলি আর বন্ধ করি। মারকাওয়া চেপে ধরে রাখে ঘাড়। ডাক্তার মৃদু¯^রে ডাকে আমায়,
হৃদি..
মারকাওয়া শব্দ করে শ্বাস ফেলে ঘাড় ছেড়ে দেয়, আমি আয়নায় তাকাই, আয়নায় হৃদিকে দেখা যাচ্ছে।
একটা মিষ্টি মায়াবী মুখশ্রী, মুখে আঁচড়। শেষ কবে এই মুখটা দেখেছিলাম। আহা হৃদি! মারকাওয়া পিছু হটে, সমস্ত শরীর ওর থর থর করে কাঁপে। কেন ভয় পাচ্ছে ও?
আমার বমি ভাব হয়। আয়না থেকে চোখ সরাই। চিৎকার করি- ওই প্রতিচ্ছবি আমার নয়। ডাক্তার হাতে হাত রাখে, কোমল ¯^রে বলে,
আপনি অনিকেত নন, হৃদি। আবার অনিকেত হৃদি দুটোই।
আমি ঘোলা চোখে তাকিয়ে থাকি। ডাক্তার কিছু¶ণ চুপ থেকে আগের চেয়ে ও শান্ত ¯^রে বলে,
আপনি খুন্নাস। যদিও আমরা বিশ্বাস করিনা... জ্বিন আর মনুষ্যের মিলনে হিজড়া সন্তান হয়। প্রকৃতির খেয়াল। আপনি পুরুষ নন, নারী ও নন। আবার একিই সাথে দুটোই।
আমি বিস্মিত চোখে আয়নায় তাকাই আবার।
শাড়ি পরা একটি চমৎকার মেয়ে, চোখে কাজল.. কপালে টিপ.. চেহারায় মেয়েলি ভাব, অপূর্ণ নারী... কিংবা অপূর্ণ পুরুষ!
আমার চোখ ভিজে উঠে।
ডাক্তারের কোমল গলার ¯^র শুনি,
শরীরের দুটো ভিন্ন ভিন্ন অংশ একে অপরকে মানতে রাজি নয়, একসাথে বয়ে বেড়াতেও নয়। স্পেকট্রোফোবিয়া! মারকাওয়ার কাজটা সহজ... একটাকে মেরে ফেললো, বাকিটাকে লুকিয়ে রাখলো আয়নার ভেতর।’
ডাক্তার চুপ করে তাকিয়ে থাকেন।
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠি। চেম্বার পেরিয়ে সামনে এগোই... রাস্তার ওপাশে ফুলের দোকান। গাঁদা, গোলাপ, রজনীগন্ধা আর বেলী ফুল... কি সুন্দর দেখতে, ছুঁয়ে দেখবো নাকি.. উফফ!
হৃদমাঝার নামের তের তলা বিল্ডিং এর ষষ্ঠ তলায় একা থাকি আমি। আজ বাসায় ফিরেই পাশের বাসায় নক দিই। ভদ্রমহিলা খুশিভরা চোখে তাকান, আবদার করি,
জমিদারবাড়ির সেঝ রাণীমার আয়নাটা দেখতে পারি আরেকবার?
রাত এগারোটা বেজে উনষাট মিনিট।
চকচকে পাথর বসানো সোনালী রঙা ফ্রেমের একটি চমৎকার ঝলমলে আয়না সামনে রেখে দাঁড়াই আমি। আয়নায় একটা মায়াবী মুখ উঁকি দেয়। আসমানী রঙের শাড়ি পরা একটি মেয়ে। চোখে কাজল, কপালে টিপ। কিছু চুল বাঁ কাঁধ বেয়ে নেমে এসেছে, টলটলে নদী। আমি হাত বাড়িয়ে দিই আয়নায়, একগাদা বেলী ফুল হাতে, মৃদু হেসে বলি,
শুভ জন্মদিন হৃদি.. তোমায় ভালোবাসি খুব।

1 comment:

Powered by Blogger.